ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নারীর স্বাধীনতা

অসাধ্য জয়ী এক অনুপ্রেরণার নাম জয়িতা পলি

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৯ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০২২
অসাধ্য জয়ী এক অনুপ্রেরণার নাম জয়িতা পলি জয়িতা পলি

রাজশাহী: রাজশাহীর সফল উদ্যোক্তা পলি খাতুন। ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ তার লৈঙ্গিক পরিচয়।

২০১৪ সালে রাজশাহী মহানগরীর মোল্লাপাড়ায় নিজ বাড়িতে মাত্র ৮ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে গড়ে তুলেন ‘ডিএ ফ্যাশন হাউজ’।  

তার এই পথচলার শুরুটা মসৃণ ছিল না। কিন্তু অদম্য ইচ্ছা, আগ্রহ ও পরিশ্রম তাকে আজ সফলতার পথ তৈরি করে দিয়েছে। এখন প্রতি মাসে তারা আয় লক্ষাধিক টাকা।

২৫ জন নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এখন ৪শ জনের অধিক তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী ও প্রান্তিক নারীরা কাজ করছেন তার অধীনে। যারা তৈরি করেন বিভিন্ন ধরনের হাতের তৈরি শাড়ি, থ্রি-পিস, বেড সিট ও কুশন কভার। তার ফ্যাশন হাউজ থেকে তৈরিকৃত এসব পণ্য দেশের বিভিন্নস্থানে বিক্রি হয়। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও গেছে তার পণ্য।  

মানুষের অসহযোগিতামূলক আচরণ কিংবা রক্ষণশীলন নীতির কারণে পলিকে বার বার হোঁচট খেতে হয়। কিন্তু সব সময় ইতিবাচক ছিলেন। সততা আর পরিশ্রমই তার নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করে। এখন তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী ও নারীদের অনুপ্রেরণার এক অনন্য নাম পলি।  

নিজের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৭ সালে পেয়েছেন ‘জয়িতা’ পুরস্কার। তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করায় ২০২১ সালে অর্জন করেন ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’। রয়েছে আরও অনেক অর্জন।  

দ্রুত বর্ধনশীল ব্যবসা আর সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ নিয়ে এখন দারুণ ব্যস্ত পলি। রাজশাহীতে এইডস প্রতিরোধ কর্মসূচি নিয়ে কাজ করেন। ‘দিনের আলো হিজড়া সংঘ’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জীবন মানোন্নয়ন ও স্বাবলম্বী করে তুলতে বিভিন্ন কাজ করছেন। স্থানীয় নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর সদস্যদের অ্যাপ্লিকস ও বুটিকসের ওপর প্রশিক্ষণ দেন। তার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেকেই। সামাজিক ও পারিবারিকভাবে নিগৃহীত বহু নারী তার হাত ধরেই পেয়েছেন বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্ন।

কীভাবে সফল উদ্যোক্তা হলেন, কীভাবে শত শত নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখছেন- এসব বিষয় নিয়ে নারী দিবসে বাংলানিউজের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। গল্পে গল্পে বলেছেন নিজের সংগ্রামের কথা।  

পলি খাতুনের জীবনের শুরুটা ছিল অবর্ণনীয় কষ্টের। নিজের ভূমিষ্ট হওয়ার ক্ষণটি থেকে থেকেই পলিকে টিকে থাকার যুদ্ধ করতে হয়েছে। তিন ভাইবোনের মধ্যে পলি সবচেয়ে বড়। জন্ম দেওয়ার জন্য তার মা নানার বাড়ি যান। জন্মের সময়ই পলির লৈঙ্গিক পার্থক্য বুঝতে পারেন সবাই।  

এই ত্রুটির কথা জানতে পেরে বাবা শুধু সন্তানই নয়, মাকেও মেনে নিতে অস্বীকার করেন। অগত্যা নানার বাড়িতেই থেকে যান মা ও সন্তান। তবুও লৈঙ্গিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ সন্তানের প্রতি মায়ের স্নেহের কমতি ছিল না এতটুকুও। মায়ের অনেক কান্নাকাটি আর অনুনয়ের পর একপর্যায়ে স্ত্রী ও সন্তানকে মেনে নেন তার বাবা।  

কিন্তু পরিবারের সদস্যদের নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে তাকে। বাবা উঠতে বসতে নির্যাতন করতেন মা ও তার ওপর। ঈদ উপলক্ষে সব ভাইবোনেরা নতুন জামা-কাপড় পেলেও পলি ছিলেন সেসব থেকে বঞ্চিত। কিন্তু মা, সন্তানকে বঞ্চিত করেননি কখনও। স্কুলে ভর্তি হতেও করতে হয়েছে সংগ্রাম। মা ছাড়া কেউ রাজি ছিল না লেখাপড়া করাতে। মায়ের ইচ্ছায় সবকিছু উপেক্ষা করে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন পলি। দৈনিক জমানো মুষ্টি চাল আর হাতের কাজ থেকে রোজগার করা টাকা দিয়ে পলির লেখাপড়ার খরচ চালাতেন মা। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পলি স্কুলের গণ্ডি পার হন। পরে ২০১২ সালে এইচএসসি পাস করেন।

২০১৫ সালে তার পাশে দাঁড়ায় ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’। সংস্থাটি তাকে প্রশিক্ষণ আর আর্থিক সহায়তা দেয় যা তাকে নতুন জীবনের সন্ধান দেয়। প্রশিক্ষণ শেষে ৮ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন পলি। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পলির কাজের দক্ষতা ও পরিসর। এভাবেই সফলতার দিকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছেন তিনি।

কীভাবে তিনি এ কাজে অনুপ্রাণিত হলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে পলি খাতুন বাংলানিউজকে বলেন, শুরুতে লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে অনেক সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে আমাকে। এখনও করছি। ছোটবেলা থেকেই আমার ড্রয়িংয়ের শখ। স্কুলে ড্রয়িংয়ে খুব ভালো ছিলাম। কিন্তু ড্রয়িংয়ের ওপর উচ্চতর পাঠ নেওয়া সম্ভব হয়নি। আঁকাআঁকির জন্য কাগজের পরিবর্তে বেছে নিয়েছি থ্রি-পিস কাপড় ও শাড়ি। ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির’ প্রশিক্ষণের কাজের দক্ষতা ও ব্যবসায়িক পরিকল্পনা লাভ করি। ধীরে ধীরে ব্যবসার পরিসর বাড়তে থাকে। ফ্যাশন হাউজের থ্রি-পিস ও শাড়ি আমি নিজেই ডিজাইন করি। সেই ডিজাইনের ওপর অ্যাপ্লিকস ও বুটিকসের কাজও করি। এখন অবশ্য ব্যবসা বড় হয়ে যাওয়ায় বুটিকসের কাজ কমিয়ে দিয়েছি।

তিনি বলেন, ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই অল্প অল্প করে ডিজাইন করতাম। এইচএসসি পাসের পর ৮ হাজার টাকা নিয়ে স্বল্প পরিসরে বুটিকসের কাজ শুরু করি। বাজার থেকে কাপড় কিনে নিজেই ডিজাইন করে অ্যাপ্লিকস ও বুটিকসের কাজ করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি শুরু করি। স্থানীয় লোকজনের মধ্যেও দুই-একজন করে কিনতে শুরু করে। তবে, আমি হিজড়া জনগোষ্ঠীর একজন হওয়ায় প্রথমে লোকজন কিনতে চাইতো না। কাজ ভালো হওয়ায় ধীরে ধীরে ক্রেতা বাড়তে থাকে।  

এখন প্রতি মাসে ৭শ পিস থ্রি-পিস ও ৫০ পিস শাড়ি তৈরি হয় তার ফ্যাশন হাউজ থেকে। প্রতিটি থ্রি-পিস বিক্রি হয় ২৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকায়। ওয়ান পিস বিক্রি হয় ৭শ থেকে ১ হাজার ১শ টাকায়। টু-পিস বিক্রি হয় ১৫০০ থেকে ২২০০ টাকায় এবং শাড়ি বিক্রি হয় ২৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকায়। খরচ বাদে গড়ে প্রতিমাসে তার দেড় লাখ টাকার মতো আয় হয়।
 
দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও গেছে পলির 'ডিএ ফ্যাশন হাউজের' পণ্য। তিনি বলেন, যশোরের এক ক্রেতার মাধ্যমে কলকাতায়ও বিক্রি হতো আমার ডিজাইন করা শাড়ি। ওই ক্রেতা মারা যাওয়ার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। সিলেটের এক ক্রেতা আমার কাছ থেকে পণ্য কিনে সরাসরি লন্ডনে পাঠায়।

এখন ৪শ জনের অধিক তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী ও প্রান্তিক নারীরা তার অধীনে কাজ করছেন। ফ্যাশন হাউজ সার্বক্ষণিক ২০ জন লোক কাজ করেন। এর মধ্যে ১০ জনই তৃতীয় লিঙ্গের। এছাড়া পলির কাছ থেকে কাজের অর্ডার নিয়ে বাসায় অ্যাপ্লিকস ও বুটিকসের কাজ করেন অসংখ্য নারী।  
 
নিজের লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণে ব্যবসায় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে জানিয়ে পলি বলেন, আমি অনেক হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষকে সম্মানজন কাজের ব্যবস্থা করেছি। তারপরও লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে অনেক সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে আমাকে। এখনও করছি। যেমন শুধু তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর একজন হওয়ার কারণে আমাকে ব্যাংক লোন দেওয়া হয়নি। আর তাই এখন আর ব্যাংকে যায় না। এগিয়ে যাচ্ছি নিজের সামর্থ অনুযায়ী।

পলি নিজেকে নারীই মনে করেন। তাই এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি বলেন, বুটিকসের কাজের মধ্যে নারীত্বের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আমার অধীনে এখন চারশো'র বেশি নারী স্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের সব সামগ্রী সরবরাহ করি। তারা নিজের বাড়িতে কাজ করেন।

পলির কাজের স্বীকৃতির জন্য রাজশাহী জেলা প্রশাসন তাকে ২০১৭ সালে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত করে। এছাড়া এসএমই আঞ্চলিক পণ্য মেলা (২০২০) এ দ্বিতীয় নারী উদ্যোক্তার পুরস্কার পান তিনি। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন তাকে ২০২০ সালের করোনাকালীন 'মানবিক যোদ্ধা' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করায় ২০২১ সালে অর্জন করেন ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’।

নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর সদস্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে গর্ববোধ করছেন উল্লেখ করে পলি বলেন, অসংখ্য নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। তাদের একটা আয়ের ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছি এবং এই টাকা নিয়ে তারা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে পারছেন। এটা আমার কাছে অনেক সুখের ও আনন্দের।

বাংলাদেশ সময়: ০৪৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০২২
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।